আপন, আউট ল আর সুদূরতা
বিজয় আহমেদ
মৃত্যুর পর, আপন যখন শহর ছেড়ে গেলো, তখন আপনকে মনে হলো ওয়েস্টার্ন কোনো বন্দুকবাজ। আউট ল। যে আসলে প্রিয় পিস্তলটা হোলস্টারে ভরে, ঢুকে পড়েছিলো শহরে, আচমকা। মেয়রের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। ঘোড়াটি ছিলো না সাথে। হয়ত পথেই মরে গেছে বেচারা! গুলি খেয়েছিলো কি? আউট ল টা জানে? আমরা জানি না। জানতে-ও পারবো না। এমন কী, আউট লটার কালো ও ঝলসে যাওয়া মুখ-মন্ডলে, ঘোড়াটার জন্যে ঘনঘোর কোনো বিষাদ ঘাপটি মেরে ছিলো কীনা, তাও জানে না কেউ। জানতে চায়-ও নি কেউ হয়ত। শহরে ঢুকার পরেই, আর কেউ না হোক, মার্শাল ও মার্শালের গোঁফ, ঠিকই হয়ত পিছু নিয়েছিলো তার?
তারপর শুরু ইদুর-বিড়াল খেলা। আর এই খেলায় নিশ্চয়ই খুব ভালো ভাবেই জড়িয়ে পড়েছিলো সে। আর এই রুক্ষ ও পাহাড়ী পথে, প্রতিটি রক্ত-কণিকার আহার যুগাবার জন্যে সংগ্রাম তো ছিলোই। দূর থেকে, মাঝরাত্রে অবিরাম গুলির শব্দ ভেসে আসতো হয়তো মাঝে মাঝে। শহরের লোকজন পরের দিন খবর পেতো, নতুন এই আউট ল, ঠিকই নিজের পায়ের তলায় মাটি যোগাড় করে ফেলছে। আর রেঞ্চের মালিকরা ঠিকই সম্ভ্রমের সাথে, মেনে নিচ্ছিলো হয়ত নতুন এই মাস্তানকে। এর মধ্যে, হয়ত আউট ল টির প্রেম-ও হয়ে একটা সাহসী তরুনীর সঙ্গে । শহরে সেই মেয়েটাকে নিয়ে কানকথাও কম ছড়াল না হয়ত। সবাই হয়তো বলাবলি করলো, এতো ভয়ানক পাগলা মেয়েরে বাবা, এত এত ভালো ছেলে থাকতে, সে কী না জড়িয়ে গেলো, চালচুলোহীন আউট লটার প্রেমে। হয়ত দূর কোথায় যেনো ঘর-ও বেধেছিলো তারা। আউট লয়ের সংসার, ভাবো!
এর ভিতর হয়ত, সমন-ও জারি করেছিলো, তার নামে মার্শাল। পালিয়ে পালিয়ে, ট্রেন ডাকাতী আর রেঞ্চ মালিকদের বখরার টাকায়, দিনগুলো হয়ত কেটেও যাচ্ছিলো তার।
এর মধ্যেই বলা নেই, কওয়া নেই। হুট করে একদিন মরে গেলো সে। কী বিস্ময়, মরেই যাবে যদি জানতো আউট ল, তাইলে কী নিজেকে জড়াতো সে এত কিছুতে! এই প্রেম, মায়ায় ও পিস্তলবাজীতে?
জানতো না বলেই, এত কিছুতে জড়িয়ে পড়েছিলো সে। আমাদের আপন-ও জানতো না। জানলে, এত কিছু, এই কবিতা, প্রেম, বিয়ে, সংগ্রাম ও গান- কোথায় ছুড়ে দিত! সারাটা জীবন হয়ত, বাবা ও মায়ের সাথে, কড়ইতলাতেই পাড় করে দিত। আপনের সাথে, আউট লটার মিল এখানেই যে বেঁচে থাকার জন্যে, দুজনকেই, অবিরাম রক্তক্ষয়ের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। পশ্চিমের আউট ল, আর আমাদের ঢাকার আপন, (কবি আপন মাহমুদ, যার সুখে-দুখে না থেকেও, নির্লজ্জের মতন বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে, লিখতে বসে গেছি আজ) দুজনকেই মৃত্যুর আগের মুহূর্তটি পর্যন্ত জন্মের প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হয়েছে। অথচ সুখ ও বেঁচে থাকার ন্যূনতম আহ্লাদ, সারাটা জীবন মরীচীকার মতন, ললিপপ হাতে লোভ দেখিয়ে গিয়েছে। অধরা থেকে গেছে। আহা বেঁচে থাকা।
আহা আপন, বন্ধু আমার-মাথা ও চোখ দুটিকে, পুরাটাই মাটির দিকে ছুড়ে দিয়ে, খুব ধীর গতিতে, হেটে আসতে আসতেই, কেটে গেলো তোর অল্প দিনের আয়ু। আহা আপন, দূর্ভাগা বন্ধু আমার…জীবন এমন কঠিন, দেখে গেলি তুই!
০২
‘ কেউ নেই চারপাশে-চলো আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা
নতুন করে নিজেদের উচ্চতা মাপি-আর সবছেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন
বন্ধুটিকে প্রশ্ন করি ‘তোমার খোড়া বন্দুটি কেমন আছে?’
খোড়া বন্ধুর খবর জানতে চেয়েছিলো আপন। এই ছিলো তার জীবন জিজ্ঞাসা! কী অদ্ভূত, সবাই যখন রিলে-রেসে দিনমান দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত, প্রথমের দিকে যখন সবার নজর, তখন কীনা আপন জানতে চাইছে শেষের মানুষটিকে! চোখ ফিরিয়ে দেখতে চাইছে পিছনে পড়ে যাওয়া মানুষটিকে! এমন বোকামীর কথা বন্ধু এই ২০১২-তে কেউ বলে? বলে না। তুই মরে গেছিস, মরে বেঁচেছিস। কিন্তু আপন, শেষের মানুষটির কে খোঁজ নিবে এখন? কে জানতে চাইবে, সবার পিছনে পড়ে যাওয়া মানুষটি কেমন আছে?
০৩
আপনের কবিতা, আপনের মতই নিরাভরণ ছিলো। ছিলো অন্তর্মুখি।যাপনের সাথে, কবিতা মিলে গেলে এমনই হয় বুঝি! আমি আর অর্পণ দেব মিলে, লাল জিপের ডায়েরী করার পর, অনেকদিন আপনকে ফোন দিয়ছি, নিজের লেখা প্রিয় কবিতা নিয়ে গদ্য লিখে দেবার জন্যে। প্রতিবারই বলেছে, দিবো। এসএমএস করেছি, অনেক সময় উত্তর-ও দেয়নি। শেষ যে দিন ফোন দিয়েছি, আমাকে বলেছিলো, ‘বিজয় আমাকে যে সংসার-যাপন-ও করতে হয় বন্ধু!’ তারপর খুব ধীরে, সেই একই কথা, ‘দিয়ে দিবো।’ আপনের লেখাটা আর দেয়া হয়ে উঠেনি। আমার খুব আশ্চর্য লেগেছিলো, আমি যখন, এ বছরের জানুয়ারীতে, আবার ঢাকা ছেড়ে আসি, চাকরীর কারণে, অনেক প্রিয় বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ যখন শূন্যের কোঠায়, তখন, হঠাৎ একদিন ফেসবুকে দেখি, ছোট্ট একটা বাক্য, ‘বিজয়, ভালো থাকিস’। এত ভালো লেগেছিলো, সেই একটা বাক্য! এত আনন্দ দিয়েছিলো সেদিন আপনের একটি লাইন। অথচ আমি কোনোদিন বলিনি, আপন খুব ভালো থাকিস। আমি ফোন দিয়ে কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি, কেমন যাচ্ছে তোর দিন, শরীর! ব্যক্তিগত সুখ-দু:খ ও স্বার্থপরতা কোনোদিন আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আপন পেরেছিলো। আপনের সাথে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিলো, মামুন, জুয়েল, রুদ্র, সুজন, ফেরদৌস ভাই, সফেদ, রাব্বানীর।হয়ত আরো অনেকের।
আমি সারা জীবন আউটসাইডার। বন্ধুদের আনন্দ ও ফূর্তির গল্প শোনেই দিন কেটেছে। ভাগ বসানোর সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে, আপন একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলো, ফেসবুকে,তার একটা লাইন ছিলো, ‘আকাশ নিয়ে তো আর ঘরে ঢোকা যায় না।’ আমি, কমেন্ট’স করেছিলাম, ‘এত ভয়ানক কবিতা।’ পরদিন দেখি, ফিরতি কমেন্ট’সে সে লিখেছে, ‘এটাকে কবিতা না ভেবে, কমেন্ট’স ভাবলেই ভালো।’ অথচ বোকা আপন বুঝেনি, কী অসাধারণ কথা সে এক লাইনে লিখেছে।
মানুষ ভালো হলে, এমন কথা বোধহয় খুব সহজেই লেখা যায়। খুব বেশি ভাবতে হয় না।
০৪
এক মিনিট আগে যে মুহূর্ত ছিলো, এখন তাই অতীত। এই ভাবেই, আজ কাল ও পরশু শেষে, এই মুহূতর্টা সুদূরতায় ভেসে চলে যাবে। ধরা যাবে না। ছোয়া যাবে না। ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্যতা কেবল। অনুভব করা যাবে। এইভাবে, ধীরে ধীরে, এই আজকের মুহূর্তের শরীরে, শাদা তুষার, আগুনের টুকরো, মলম, ওষুধ এসে জড়ো হবে।অতীত হয়ে উঠবে। তখন রোমন্থন অথবা ভুলে যাওয় ছাড়া এই জাগতিক মানুষের আর কীইবা নিয়তি!
ভাবতে অবাক লাগে, ১২তারিখের পর থেকে পর থেকে, আপন এখন অতীত! সিম্পলি অতীত! এত সহজে মানুষ পাস-টেন্স হয়ে যায়! এত সহজে মানুষ, কেবল রোমন্থনের বিষয়। আশ্চর্য লাগে।
আমাদের আরো আশ্চর্য করে দেবার জন্যেই বুঝি, মার্শালকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো আপন হঠাত, নিজের পিস্তলটি গুটিয়ে নিলো। আর বললো, ‘আর নয়, যাই।’
আর আমরা দেখলাম, আউট ল টা মাঠ ছেড়ে যাচ্ছে। আমাদের জীবীত সবাইকে পিস্তলবাজীর সুযোগ করে দিয়ে। থ্যাঙ্কস বলতে ইচ্ছে করে না। পিস্তলবাজী শেখার জন্যে উস্তাদ লাগে যে। জীবনের সাথে এমন এলেবেলে টাইপের মস্করা শেখার জন্যে-ও উস্তাদ লাগে! উস্তাদ পাবো কই বন্ধু!
Pingback: মনখারাপের পৃষ্ঠা উল্টাই, ভাবি আহা। আপন মাহমুদ সংখ্যা।গদ্য-৬। | লাল জীপের ডায়েরী
Pingback: আপন মাহমুদের মৃত্যু / ইমতিয়াজ মাহমুদ | লাল জীপের ডায়েরী
Pingback: মনখারাপের পৃষ্ঠা উল্টাই, ভাবি আহা। আপন মাহমুদ সংখ্যা।গদ্য-২। | লাল জীপের ডায়েরী
Pingback: মনখারাপের পৃষ্ঠা উল্টাই, ভাবি আহা। আপন মাহমুদ সংখ্যা।গদ্য-১। | লাল জীপের ডায়েরী