আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা / পাবলো শাহি

আবদুল মান্নান সৈয়দবাংলা কবিতার ক্ষেত্রে ষাটের দশকে যিনি পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে বিশুদ্ধ ভাবে অনুসরণ করতে পেরেছিলেন তিনি আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০), আর সেক্ষেত্রে তিনিই সম্ভবত একমাত্র কবি, যে এই ধারার সূচনা করেছেন বাংলা কবিতায়। স্বজ্ঞানতা, কোলাজধর্মিতা, ফ্রয়েডিয় মুগ্ধতা, নগ্নবাস্তবতা, অস্পষ্টতা, অনিশ্চয়তা, শিল্পপ্রমূর্তির প্রসরতা ইত্যাদি ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা করা যায় আধুনিক শিল্পকে; মান্নান সৈয়দ এর কবিতায় এই সব ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দের অবস্থান চিহ্নিত হতে পারে কলাকৈবল্যবাদী কবি হিসাবে। জীবনের দুর্বিষহ সংগ্রাম ও আলোড়নকে স্বীকার করে নিয়েই তিনি নিমজ্জিত থাকতে চান স্বেচ্ছা-আত্ম-বিস্মৃত এক জগতে। তাঁর আত্ম-উদারবর্তদ্রষ্টাসুলভ জীবন ভঙ্গি তাঁকে শুদ্ধ শিল্প অন্বেষার নামে পলায়নবাদীও করে তুলেছে খানিকটা। আর্টস ফর আর্টের প্রবক্তা হিসাবে  মান্নান সৈয়দ ঘাটের সময়পর্বে নিজেকে প্রকাশ করেছেন তাঁর শিল্প-অন্বেষী চেতনায়।

মূলত মান্নান সৈয়দ নান্দনিক শুদ্ধাচারের ভিতর বোধের সারাৎসার নিয়ে বোধিকে ধারণ করতে চেয়েছিলেন। কবিতা, এই ধারার হাতে, হয়ে ওঠে সশ্রম সপারগতা নির্মাণ-কৌশলের অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ। এই ধারার সূচনা ও পরিচর্যা বহুলাংশে যাঁর হাতে ঘটেছিল তিনি আবদুল মান্নান সৈয়দ- এই ধারার নিঃসঙ্গ ও প্রায় একক প্রতিনিধি তিনি।

কবিতার এই উদ্ভাবনা থেকেই তাঁর কবিতায় বিষয় হয়ে ওঠে পরাবাস্তবতা। তাঁর হাত ধরেই পরাবাস্তব ভাবনা বাংলা কবিতায় ডানামেলে উড়াউড়ি শুরু করে। ফলে তাঁর কবিতায় উড়ে এসে বসে ধোঁয়াটে মাছি, রঙের আচ্ছন্নতা কিংবা মোহময় প্রহেলিকার সৃষ্টি জগৎ, এই জগৎ-ই মান্নান সৈয়দের অভীষ্ঠ-

তাঁর নিজের ভাষায় কবি ও কবিতা ভাবনা উপস্থিত এই সূত্র ধরেই।

(এক)
কবির কৃত্য তিনটি: গোপনতা, নীরবতা, একাকিত্ব। কিংবা, সম্মিলিত অর্থে, ধ্যান। ঠিক প্রচলিত অর্থে নয়, একটু বাঁকিয়ে- ধরা অর্থে। কবির নীরবতা মানে জনসমক্ষে চুপ ক’রে থাকা নয়, গোপনতা মানে লুকিয়ে ফেরা নয়, একাকিত্ব মানে অসামাজিকতা নয়, ধ্যান মানে নয় আরাধানা। প্রকৃত কবি, কিংবা প্রকৃত কবির অন্তর, এই সমস্ত জিনিশকেই ভিতরে-ভিতরে বহন করে।

(দুই)
কবিতা লেখার জন্যে নিজের গভীরবিবরে ঢুকে যাওয়া চাই। সেখানে সমাজ নেই, ধর্ম নেই, রাষ্ট্র নেই; সেখানে আছে এক অপার অনন্ত আমি। সেখানকার সমুদ্রের নাম আমি, আর যে-একখানি দ্বীপ আছে তার নামও আমি, আর সেই দ্বীপ যে- একখানি কাগজের নৌকো বাঁধা আছে তার নামও আমি।

(তিন)
কবিতা এমন-এক জিনিশ, যা শরীর ও আত্মা সর্বস্ব দখল করে। কবিতা দখলকারী মানুষ এক অন্ধের মতো, যার আলোকময়তা আর-সবার চেয়ে বেশি। কবিতা দখলকারী মানুষ এক নগ্নের মতো, যার আবরণ আর সবার চেয়ে মূল্যবান।

(চার)
সৎ ও প্রকৃত কবিকে তাই কবিতার শরীর ব্যাপারেও সমান সচেতন হ’তে হয়, কবিকে তাই শিক্ষিত হ’তে হয়, …সৎ ও প্রকৃত কবি তাই একই সঙ্গে অভিকামী ও অতীন্দ্রিয়, উদাসীন ও বলাৎকারী। রাজা ও ঋষি।

(পাঁচ)
কবিতার আধার ও আধেয় তুল্য মূল্য।

(ছয়)
ধ্বনি কবিতার আত্মা। আমরা কি তাকেই এক-মুহূর্তে কবিতা ব’লে শনাক্ত করি না, যার অব্যাখ্যাত আওয়াজ মন্ত্রোরমতো, মন্ত্রোচ্চারিত সম্মোহনের মতো? কবিতা যে- সম্মোহন বা আবেশ সৃষ্টি করে, তা কিসের? তা উচ্চারণের, তা ধ্বনিময় শব্দের, তা শব্দোত্থিত আওয়াজের। প্রাত্যহ শব্দ ধুলো-কাদায় লিপ্ত কবিতার নবধারাজল তাকে ধুয়ে-মুছে নতুন করে তোলে।

(সাত)
কবিতা কাদের জন্যে? না, কবিতা সবার জন্য নয়। …একধরনের অনুভূতিশীলদের জন্য, যাঁদের হৃদয়ী সংক্রাম তীব্র, যাঁদের সংবেদন শততল, যাঁদের মৌল মনোপ্রতিন্যাস কল্পনা-ভরা।

(আট)
জীবন এক জটিল অরণ্য, কবিতা তার চাঁদ, ফাঁক ফোকর থেকে এসে পড়েই।

এই ভাবনাগুলি আত্মমুখিতা, রূপকল্প নির্মাণে কূটাভাসপূর্ণ ও পরাবাস্তবতার নির্যাসে পূর্ণ। হয়তো অনেক কিছু কিংবা কিছুই নয়- শূন্য। এরকম দোলাচলেপূর্ণ। মান্নান সৈয়দ এর কবিতাগুলি এ মন্ত্রে উজ্জীবিত, এই নবধারাজলে স্নাত। যা কিনা ‘কবিতার প্রচলিত ভাষারীতির বিরুদ্ধে।’ ফলে, তাঁর প্রথম কবিতার বই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ বইটি বিশ্বসাহিত্যের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অবচেতনকে ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবে। সঙ্গত কারণেই উল্লম্ফনকামী বিক্ষিপ্ত পরিকল্পের ভিতর তাঁর ভাবজগতের অনুবর্তন, আর এখানে নির্মিত তাঁর মগ্নচৈতন্যের শীষে ঝুলে থাকা পরাবাস্তবতার নতুন বুনট (Texture) এবং তা চেতন-অবচেতন অনুভব থেকে উত্থিত।

(এক)
    জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়, আমার
    চারিদিকে যতোগুলো দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের;
    জ্বলছে গাছসকল সবুজ মশাল; বাস্ একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি
    নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র; আর সমস্তের উপর বরফপড়ছে। -এ-রকম
    দৃশ্যে আহত হ’য়ে আমি শুয়ে আছি পথের উপর, আমার পাপের
    দু’চোখ চাঁদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হ’য়ে গেলো, আর যে- আমার জন্ম
    হ’লো তোমাদের করতলে মনোজ সে অশোক সে: জ্যোৎস্না তার
    কাছে ভূত কিন্তু একটি গানের উপর, দরোজা তার কাছে পুলিশ কিন্তু
    একটি জন্মের উপর, মৃত্যু তার কাছে দোজখ কিন্তু একটি ফুলের উপর।
                                                         [‘অশোক-কানন’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]
(দুই)
    কী চড়া বাজার! আমাদের পাশের লোকটির সত্যি-সত্যি গলা কেটে নিল
    চীনে প্লেটের উপর এক গাঢ় দোকানদার। এরকম প্রমাণ আমি কখনো
    দেখিনি। তারপর করল কি? -না, তার কাটা-মুণ্ডু ঝুলিয়ে দিল দোকানের
    উইণ্ডোর নিচে বিজ্ঞাপনে টপাটপ।
                                 [‘সমস্ত ভাসান দিলাম সমস্ত উড়াল’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]

(তিন)
    জিরাফের গলা বেয়ে লতিয়ে উঠতে দেয় আগুন, সেটা আমাদের
    আকাক্সক্ষা, অবশ্য যদি তার মাংস হ’তে রাজি হই, তুমি আর আমি;
    ঈশ্বরনামক গৃহপালিত মিস্তিরি ভুল সিঁড়ি বানাচ্ছে আমাদের
    উঠোনে ব’সে- আগুনের, যে- অসম্ভবের সিঁড়িতে উঠতে-উঠতে আমরা
    সবাই পাতালে নেমে যাবো হঠাৎ।
                                                [পাগল এই রাত্রিরা’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]

আবদুল মান্নান সৈয়দ শিল্প সচেতন কবি, বিষয় সচেতন কবি নন। তাঁর কবিতা তাই বোধের বুদ্বুদ, বহির্বিশ্বের জানালা কিন্তু বৈশ্বিক সংকট নেই। ষাটের অন্যকবিরা যেখানে সামাজিক সত্তাকে কবিতার প্রবল বিষয় হিসাবে  উপস্থাপন করেছেন, সে ক্ষেতে অন্তর্জগতই তাঁর কবিতা প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁর বহির্জগত নির্মাণ হয় অন্তর্জগতের প্রিজমের মধ্যেই। কবির অন্তঃদেশে যে বিস্ময়, যে কূটাভাস, যে নতুন আবিষ্কৃত জগত নির্মিত হয়ে- এই কবিতাগুলির মূল সূর নিমগ্নতা, বেদনার অভিঘাত এবং বাস্তবতার ছায়াপত লক্ষণীয়। মান্নান সৈয়দও বর্ণোজ্বল সাংকেতিক ধ্বনিতে সংযত উচ্চারণে প্রকাশ করেন ইন্দ্রিয়ঘন চিত্রকল্প ও শৈল্পিক বাকপ্রতিমা।

মান্নান শব্দ আর ধ্বনির কারিগর। মান্নানের মধ্যে এও একটি স্পর্ধার মতো ব্যাপার। মান্নানের সমকালীনদের মধ্যে শুধু নয়, অন্য দশকেও তাঁর মতো শব্দ-সচেতন কবি নেই। ধ্বনি চেতনা মান্নানকে এক নিখুঁত কলার সন্ধান দিয়েছে।

ফলে মান্নান সৈয়দ এর কাব্যজগত অন্যরকম এক চৈতন্যের জগত-

বস্তুত, চেনা-জানা পৃথিবী বহির্ভূত যে অচেনা অদেখা জগৎ কবির আন্তঃভাবনায় পরিক্রমশীল, তার অতিনির্দিষ্ট আয়তন বা বলয় যেন আধো আলো আধো অন্ধকারে নিমজ্জিত তেমনি তার অস্তিত্ব নিঃশঙ্ক, নিঃশব্দ ও পরাক্রমশালী। ফলে কবিকে হতেই হয় অনুগত দাস, কেননা তাঁর বিস্ময়ের অবধি নেই।৪০

   (এক)
        চিৎকারের নিচে প’ড়ে আছে আমাদের শাদা শহর- তারপিঠ, কাঁধ, গ্রীবা
        উরু, জানুঃ এক-ফোঁটা আস্বচ্ছবিহ্বল নীল শিশির সময়ের সবুজ
        পাতায়। কল্যাণ, জলের মতো, আমাদের মাথার উপরে প্রতীক্ষায়।
        ছোটো দিন:- পাশের বনে শব্দ নেই, শহরে হাওয়া নেই, শহরে একটা
        মূর্ছা। চটের মতো চোখ বেঁধে নিয়েছে কুয়াশা মানুষের-মানুষের।
                                                                  [‘পরস্পর’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]
   
    (দুই)
        হে চাঁদ, তুমি কি ঈশ্বরের ঘড়ি? একটা দুঃখিত পাথর? হার্দ্য হাঁসের
        রুপোলি ডিম?
                                                            [‘চাঁদে পাওয়া’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]
   
    (তিন)
        পাপ কে না-ডাকলে চ’লে আসে রোজ, রক্তের ভিতরে আছে নিমন্ত্রণ।
        সেই নিমন্ত্রণে পাপের দু’ চোখে দুটো চাঁদের মতো অন্ধ হ’য়ে যায়,
        পূর্ণিমার চাঁদের মতো অন্ধ, এক অন্ধ আর-এক অন্ধকে পথ দেখিয়ে
        নিয়ে যায়, তাই চাঁদ বলে- রাস্তা ও সমুদ্র, জল ও নগর, টাকা ও
        ভালোবাসা। অথবা পাপ কী? রক্তের ভিতরে আছে শত-শত চাঁদ,
        তারা-তো সমুদ্রকে বরফ ও মুক্তার হাত ধ’রে ডেকে আনবেই, নিমন্ত্রণে
        তাদের চোখ উজ্জ্বল কিন্তু দান অন্ধ, উজ্জ্বল ও অন্ধ প্রেমিক-প্রেমিকার
        মতো গলায় গলা জড়িয়ে পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে যায় চির
        কালের পথ ধ’রে, সব এলোমেলো অন্ধ ও উজ্জ্বলের পায়ের নিচে
        শিল্পীর মতো মর্মরিত হয়।
                                      [‘টুকরো-টুকরো মৃত্যু’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]

মান্নান সৈয়দ জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ, জ্যোৎস্না রোদ্রের চিকিৎসা এই দুটি কবিতা গ্রন্থের মধ্যদিয়ে বাংলা কবিতায় প্রকাশ ঘটালেন বিশুদ্ধ কবিতার ধারা। এই বিশুদ্ধতা যে অর্থে বিশুদ্ধ তা হচ্ছে- যা সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে অস্বীকার করে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিশুদ্ধতা। অবশ্য এই ধারা তাঁর কবিতার একমাত্র ধারা নয় এগুলিকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলা শুরু করলেও সামাজিক মানুষের যুগবিধৃত শৈশব-কৈশোর-যৌবন বিভিন্ন কাল পর্যায়ের বেদনাময় স্মৃতি ও তাঁর কবিতার বক্ষে লুকায়িত। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি জীবন আয়ুর বিভিন্নস্তরগত অভীপ্সা অন্বেষণ, স্বপ্ন ও কালিক মূল ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত ক্ষোভযন্ত্রণা দগ্ধ, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠামথিত রক্তাক্ত হৃদয়াবেগ তাঁর কবিতায় উপস্থিত।

    পালিয়ে-আসা গ্রামে কোনোদিন ফেরা হবে না আর…
    …
    সাত-দিন সাত-রাত নৌকোয় নৌকোয় পার হ’য়ে
    মূল ভূখণ্ড তুমি হারিয়ে ফেলেছো চিরতরে
                চি-র-ত-রে
    মূলভূখণ্ড তুমি হারিয়ে ফেলেছো
    তবু শিকড়ের টান তোমাকে বানিয়েছে কবি
    তোমার জন্মগ্রামের মাটি তোমার আত্মায় লেগে আছে
                                    [‘উদ্বাস্তু কবি’, ঘুমের ভিতরে নিদ্রাহীন]

মান্নান সৈয়দের কবিতার মূল ভূখণ্ড মনস্তত্ত্বের প্রত্ন-উৎসবের গভীরে লীন হয়ে যাওয়া কিন্তু এর মধ্যে উঁকি দিয়েছে বাস্তব, স্বপ্ন আর পুরানো ক্ষত। কবি মানবের পদচিহ্নহীন তাঁর মনের দরোজায় হাজির করেন আমাদের। তাই তার স্বপ্নের কাচের জুতো বাস্তবের আঘাতে খান খান হয়ে ওঠে। এই চির আহত কবিমন পরাবাস্তবতার হাত ধরে বাস্তবতায় ফিরে আসেন নির্মাণ করেন কবিতায় আদিম নববিশ্ব।

    এক একবার আমার স্বপ্নের কাচের জুতো
        বাস্তবের আঘাতে হয়ে গেছে খান খান…
    …
    আর যতোবার আহত হয়েছি
    ততোবার আমার পুরোনো একটি ক্ষত ফেটে
    পাঁচ-সাতটি রন্দ্র-থেকে
    ছোট্টো এক ফোয়ারার মতো
    সরু ও ক্ষীণ রক্তের ধারা আতীব্র ছুটে গেছে…
    …
    কিন্তু জেনো
    আমার ভিতরে এমন একটি জায়গা আছে
    যেখানে আমি কোনো দিন আহত হবো না
    সেখানে কোনো মানবের পদচিহ্ন পড়েনি
                   [‘আহত আমি অনাহত আমি’, ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ]

লক্ষণীয় প্রসঙ্গ এই যে,

কোনো প্রসঙ্গ নিয়েই হয়তো কবিতা লিখতে চান নি তিনি; আত্মগত, ব্যক্তিক অনুভবকেই ভাষারূপ নিতে চেয়েছেন। আর এই জন্যেই কবিতায় তিনি গ্রহণ করেন অবচেতনার পদ্ধতি। ভাষা তাই হয়ে ওঠে চৈতন্য প্রবাহের অনুসারী, পরাবাস্তবময়। ফলে যে-সব অনুষঙ্গ তুলে আনা হয়, সেই অনুষঙ্গই ভেঙেদেয় তাদের নিজস্ব যৌক্তিক সীমা। অথবা যে-সব বিমূর্ত, অবয়বহীন অনুষঙ্গকে কবিতায় স্থান দেওয়া হয়, সেই অনুষঙ্গকে শরীরী করে তুলে তাতে কবি সঞ্চারিত করে দিতে চান কোনো মনোজাগতিক সমস্যা বা চেতনাকে।

মান্নান সৈয়দের কবিতায় কখনো অশরীরী অনুষঙ্গ কখনো নিজস্ব বিচরণের জগত অতিক্রম করে মনোজাগতিক ব্যক্তিগত ভাষা হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে তাঁর কল্পনা শক্তি কবিতার নতুন ভাষা নির্মাণ করে- অনেক-ক্ষেত্রে তা অনুষঙ্গবর্জিত ঠিকই তবু এই সাংগীতিক, বিমূর্ত অনুভূতি নির্ভর হয়েও তা শব্দ, ছবি, বর্ণ বা সাংগীতিক বা অনুভবের শব্দ খেলা নয়।

(এক)
    ভালোবাসা নাুী পাপ করে কেউ নিস্তার পায় না। ভালোবাসা মানে
    ভীষণ বিজয়, অপরের আত্মা ছোঁবার ভীষণ বিজয়। তোতাপাখিদের
    লাল-সবুজ আক্রমণে বেশামাল প্রথম আবিষ্কারক, অপরের আত্মা ছুঁয়ে
    কলঙ্কিত করবার স্পর্ধা তোমার কেন? হৃদয় বিশাল ছুঁয়ে গেলে
    আছড়াতে-আছড়াতে চলে যায় পাখি; সময় তাকে তফাৎ করেছে।
    পৃথিবীতে একটি সারক্ষণ পাখি জীবনের ঔরসে প্রসব করে বন্দুকের
    গুলি। দু-জন তাকে দেখেছিলো: ভালোবাসা ও ভূতঃ তারা পরস্পরকে
    সেই  পাখি ভাবে।
                                               [‘টুকরো টুকরো মৃত্যু’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]

(দুই)
    কবি ও পাগল, ইন্দ্রিয়ের বৈকল্যে যারা ভোগেন,
    এইপুরোনো বাড়িতে পাগল রাত্রিতে তাদের জন্য আগুন লেগেছে,
    যে-আগুন সর্বাঙ্গজুড়োয় নিঃশব্দে।
                                             [‘পাগল এই রাত্রিরা’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]
(তিন)
    পাপের ভিতর গোলাপ থাকে, এমনকি শব্দের পাপেও, কবিরা যেমন।
                                              [‘পাগল এই রাত্রিরা’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]

হয়তো প্রকরণগত কারণে তার কবিতা ‘অনুভবের বিমূর্ত সাংগীতিক খেলামাত্র।’ সেক্ষেত্রে ‘আবদুল মান্নান সৈয়দের ষাটের পর্বের কবিতা মূলত এই অপচয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ সমালোচকের এই ভাষ্য তাঁর ষাট পর্বে কবিতার ক্ষেত্রে সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। কেননা, ‘ভালোবাসা ও ভূত পরস্পরকে পাখি ভাবে’ ‘কবি ও পাগল ইন্দ্রিয়ের বৈকল্যে ভোগে’ ‘শব্দের পাপের মধ্যে কবির বসবাস’ -এখানে ইন্দ্রিয় জগতের উদ্ভাস থেকে ভেসে আসে চিরবাস্তব জগতের বৈকল্যময় সমাজের দগদগে ক্ষত। মান্নান সৈয়দ অসম্ভব শব্দীয় ইন্দ্রজালে এই আপাতত অসম্ভবকে কবিতার বর্ণে সম্ভব করে তোলেন। এ ব্যাপারে কবির ব্যাখ্যা উল্লেখযোগ্য-

আমি ছিলাম ছোটোবেলা থেকেই দুঃস্বপ্নগ্রস্ত, দুঃস্বপ্নের সন্তানও বটে। আমার প্রথম দিককার কবিতায় (ও গল্পে) জীবনের এই দুঃস্বপ্নের ছায়াই বিস্তারিত। শুধু তাই নয়, আমার স্বপ্নকল্পনা সব সময় করাতের মতো বস্তুকে ভেদ করতে চেয়েছে।

এই স্বাতন্ত্র্যের হাত ধরেই, নির্বাসিত স্বপ্নলোক ও শৃঙ্খলাহীন জগৎকে আাবিষ্কার করেই কবিতার হাত বাড়ালেন মান্নান সৈয়দ। ফলে, অর্ধচেতনা, অবচেতনার নীল স্রোতে মেঘ উড়ালেন কবি। আর সেই ভাষা হয়ে উঠল তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গ-

(এক)
    সিংহের খাঁচায় বসে আমি গল্প লিখছি মনে মনে।
                             [‘পাগল এই রাত্রিরা’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]

(দুই)
    আমার কয়েক ঘন্টার খাদ্য, এই বারান্দা এই চৌকাঠ এই মেঘ
                        [‘পাগল এই রাত্রিরা’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]

(তিন)
    আমার একটি মাত্র কান্নার ফোঁটার উপর
    বিরাট একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, নোঙর নেমে গেছে
    মাটি ভেদ করে পাতালের দিকে।
                            [‘পাগল এই রাত্রিরা’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]

সম্ভবত সেকারণে কবিতার সংজ্ঞাদেন তিনি এভাবে-

কবিতা মানে রূপান্তর, কবিতা মানে বদল, কবিতা মানে পরিবর্তন। কবিতা মানে অবৈকল্য নয়, কবিতা মানে তির্যকতা। কবিতা নয় বস্তু ফলক, এমনকি কবিতা কল্পনাফলকও নয়। কবিতা বস্তুকে তো   রূপান্তরিত করেই, এমনকি কল্পনাকেও পরিবর্তিত করে।

আইয়ুবী কালো দশকেও কবি তাই প্রবেশ করতে পারেন জ্যোৎস্নায়, যে জ্যোৎস্না ‘একগুচ্ছ ভুল-শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে/ঘিরে জ্বল-জ্বলে চিৎকার।’ তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বাণী ‘সমস্ত ভাসায় দিলাম সমস্ত উড়াল’। কবির মতে রিয়ালিজম নয়, স্যুররিয়ালিজম পারে প্রকৃত সত্যকে ধারণ করতে।

ষাট দশকের প্রথমার্ধের কবিতায় যে অনিকেতচেতনা, নৈরাশ্য, নির্বেদ যৌনতার স্বাক্ষর অনিবার্য কবি স্বাতন্ত্র্যপূর্ণভাবে তার থেকে দূরবর্তী। তাঁর গণিকারা শরীরী আশ্লেষে আকীর্ণ নয়, হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসমান। এ পর্বে আবদুল মান্নান সৈয়দ সত্যকে ধারণ করতে চেয়ে পরাবাস্তবতার জগতে পরিভ্রাম্যমাণ…।

তাঁর পরাবাস্তবতায় বেদনা ফেটে পড়ে হাজারও ধ্বনিতে, দালির গলে যাওয়া ছবির মতো, পাঠকের অভিক্ষেপ গলিত মোথিত হয়ে ওঠে, কেননা ‘জানালার পাহাড় হয়ে উঠেছে শরীর’ ‘বাইরে তেতো রাত’ ‘গনগনে জানোয়ার’ ‘লাইব্রেরির উরু’ ‘হাঁসগুলির বরফ প্রসব করা’ এই সব ঘটনা প্রবাহ তাঁর কবিতাকে যন্ত্রণার অভিক্ষেপে ও পরাবাস্তবাতার প্রলম্বিত আকষর্ণে টেনে নিয়ে যায়।

মান্নান সৈয়দ-এর চতুর্থ কাব্য গ্রন্থ ও সংবেদন ও জরতরঙ্গ কিন্তু প্রথম গ্রন্থ জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছে যে ইশতেহার তিনি ঘোষণা করে ছিলেন- সেই পরাবাস্তবতার রাহস্যিক যাদু থেকে তিনি সরে আসতে পারেন নি খুব একটা। রক্তাক্ত বাংলা একাত্তর তাঁকে ছুয়ে গেলেও তা এসেছে পরাবাস্ততারই হাত ধরে।

    আমার ঘরের পাশে একটি লাশ শায়িত
    লাশ গোলাপ-বাগানে
    তার কপালে তারার মতো এসে বিঁধেছে একটি বুলেট
    তার বুলেট-বেঁধা কপালোৎস থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি রক্তের নদী
                                           [‘স্বপ্নের এ্যানটেনা’, ও সংবেদন ও জরতরঙ্গ]

মান্নান সৈয়দ এর পরীবর্তী কাব্যগ্রন্থ ঘুমের ভেতরে নিদ্রাহীন গ্রন্থেও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত-

    পৃথিবীর সব ছুরির উপর
    কেবলি এসে-এসে পড়ে
    স্বর্গের সব আপেল
                    [‘সূর্যের ছেলে/ঘুমের ভেতরে নিদ্রাহীন’, ও সংবেদন ও জরতরঙ্গ]

মান্নান সৈয়দ এর কবিতা বিষয়ে সমালোচকদের কিছু উল্লেখযোগ্য মন্তব্য-

(এক)
মান্নান আঙ্গিকের দিক থেকে পুরোপুরি পরাবাস্তবতাবাদী বা স্যুররিয়ালিস্ট। চিত্রকল্পের মাধ্যমেই তার ভাবজগৎ নির্মিত। মান্নানকে ভুল-বোঝাবুঝির তাই যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিন্তু ইউরোপীয় কাব্যধারার সঙ্গে পরিচয় থাকলে, এমন হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা কম। সংকুচিত পৃথিবীতে শিল্পের ভাববস্তু (Content) হোক জাতীয়, আকার প্রকার বা গড়ন (Form) হোক আন্তর্জাতিক। গ্রাম্যতা সর্বতোভাবে বর্জনীয়। নতুন টেকনিক আমদানী কোন অপরাধ নয়। শুধু প্রশ্ন, তার সাফল্য দেশী ঐতিহ্যে কতটুকু সুসঙ্গতি লাভ করেছে। মান্নান এই ক্ষেত্রে আশ্চর্যরকমে অনেক খানি সফল। [‘শওকত ওসমান’, সমকাল, মাঘ-চৈত্র-১৩৭৩]

(দুই)
জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ হাতে নিয়ে একজন নিশ্চক্ষু পাঠকও, …অনুভব করবেন যে এই কবিতাগুচ্ছ অর্ধমনস্ক মৌলিক প্রয়াসের ফসল নয়। এই কবিতাগুলো রচিত হবার পেছনে প্রতিটি পঙ্ক্তি নির্মিত হবার উদ্যোগে চেষ্টা শ্রম ও অধ্যবসায়ের কর্মই চেষ্টায় হাত দিয়েছেন কবি, সচেতন ও সক্লেশ ভাবে চেষ্টা করেছেন গতানুগতিক কবিতার সহজ মসৃণ ও পরিচিত জগৎ থেকে, চেনারূপকল্প ও পুরোনো উপমার ভিড় থেকে- নিজেকে পৃথক করে তুলতে।… বিরামহীন, নিবৃত্তিহীনভাবে তিনি খুঁজে যাচ্ছেন স্বকীয়তা- [‘আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ’, কণ্ঠস্বর, মে-জুন ১৯৬৭]

প্রথানুগামী, ব্যাকরণ-ভীরু এবং সনাতন-পন্থাকে আঁকড়ে থাকা কবিদের থেকে আলাদা হতে চেয়েছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। তাঁর কবিতায় তাকাবার চোখ অভিনব ও মৌলিক, স্বতন্ত্র ও স্বকীয়। এই নতুন কাব্যভাষা নির্মাণে মান্নান বেছে নিয়েছেন মগ্ন চৈতন্যের আলো আঁধারী ভাষা।

আবদুল মান্নান সৈয়দ অবচেতনের গুল্মময় প্রদেশে শিল্পশুদ্ধির অন্তরালে আড়াল করেছেন নিজের শিল্পচৈতন্যে ও সমাজমনস্ক দায়বদ্ধতা। তাঁর দার্শনিক বোধও একই সূত্রে নিহিত। ষাটের অভিযোজনহীন অস্তিত্বসঙ্কটের প্রাবল্যে শুদ্ধসত্তায় উপনীত না হতে পেরেই তিনি অবচেতনের বেড়াজালে নিজেকে আড়াল করেছেন। আসলে অস্তিত্ববাদী দর্শনের এটিও এক বিপরীত প্রান্ত। ব্যক্তির আত্মগত সঙ্কট স্থির সামাজিক কল্যাণকামিতায় মোকাবেলা করতে না পেরে তার উল্টো আত্মনিমজ্জন ঘটে। তারপরও মান্নান সৈয়দের কবিতায় তাঁর অসহায়ত্ব, একাকিত্ব ও দুঃস্বপ্নময় কুহকী তমাসাচ্ছন্ন জীবনের চিত্র উঠে এসেছে তাঁর পরাবাস্তব চেতনাবাহী কবিতাগুলোর মধ্যে।

ফলে বাইরের পৃথিবীর আলোড়ন ও উত্তেজনা তাঁর কবিতায় সুস্পষ্ট নয় না বরং শিল্পান্বেষী এক মায়াবী আছন্নতায় তিনি নিজেকে নিমজ্জন রাখেন। বাস্তব জগত থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন মগ্ন চৈতন্যের শীষে।

বস্তুত, চল্লিশ-পরবর্তী বাংলা কবিতায় প্রতারক জ্যোৎস্না এবং চক্ষুহীন কুয়াশার এমন হাতধরাধরি আর কখনো ঘটেনি। আমাদের চৈতন্যের ভেতর দূরে কোথাও শুনতে চাই হ্রেষা, কিন্তু আমার ঐ ঘোড়ার পশ্চাদ্ধাবন করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি অচিরাৎ, এবং শব্দের সম্মোহন আমাদের পুরস্কারকে ব্যঙ্গ করে রঙ্গময়ী নটিনীর মতো ক্রমাগত পশ্চাৎ দোলাতে থাকে। নিজের নাভিতে নিমগ্নদৃষ্টি মান্নান সৈয়দকে আমরা, একসময়, আবিষ্কার করি নিজের সৃষ্ট অপরূপ শব্দবাগানের মধ্যে নিহত।

মান্নান সৈয়দ বহির্পৃথিবী ছেড়ে মনের জানালায় আঁকেন বোধের বিম্বিত দর্পন। তাঁর কবিতার শব্দগুলি ইন্দ্রিয়নির্ভর নতুন শব্দ নির্মাণ ও শব্দের অভিনব দ্যোতনা সংযোজন মান্নানের কবিসত্তার সহজাত আবেদন। জগতের দৃশ্য-ধ্বনি-গন্ধ-স্পর্শে তা মায়াবী জাল তৈরি করে। তাঁর এই ইন্দ্রিয় সম্ভোগ শেষের দিককার কবিতায় লিবিডোলিপ্ততায় পর্যবসিত হয়েছে। তারপরও তাঁর প্রধান প্রবণতা প্রথম গ্রন্থের মধ্যেই ইশতেহারের মতো ঘোষিত হয়েছে। ফলে, বাংলাদেশের কবিতায় তিনি চিহ্নিত হয়ে থাকবেন শিল্পসচেতন কবি হিসাবে , ষাট দশকের উপমাময় কবি হিসাবে  এবং বাংলাদেশের কবিতার প্রধান প্রবণতা রাজনীতি সচেতন ও উচ্চকিত স্বর থেকে দূরে এক স্বনির্বাসিত শিল্পব্যাকরণের কবি হিসাবে ।
………………………………………………………………………………………………….

পাবলো শাহি

কবি ও গদ্যকার

Leave a comment

Filed under সারথি

Leave a comment