একশ ছিচল্লিশ নং হাতিরপুলের গাছপালা (দ্বিতীয় পর্ব) / মেসবা আলম অর্ঘ্য

[প্রথম পর্বের লিঙ্ক]

 

             তিনতলার ছাদ থেকে হাফিজাবানুর ছোট ছেলে মাথা বার করে আছে। উনি চেক করছে কে কে ফৃ স্কুল স্ট্রিটের চিপার হোটেলে দৃশ্যমান। ওনাকে দেখে আমরা অদৃশ্য হয়ে যাই।

একশ ছিচল্লিশে হাস্নাহেনার গাছ ছিল। নুরুমিয়া বলতো হাস্নাহেনার গন্ধে সাপ আসে। আমাদের কুকুর ছিল। ভূতেরগলি থেকে প্রায় প্রায় শিশুকুকুর ধরে আনা হতো। তাদের ফিডারে করে দুধ খাওয়ানো হতো। ছালা দিয়ে ঘর বানাতাম। শিশুর চিন্তায় ঘুম আসতোনা।

একবার শীতে একটা কুকুর মারা যায়। আমরা আরেকটা শিশুকুকুর জোগাড় করি। কয়েক মাসেই সেটা তাগড়া যুবতী হয়ে ওঠে। গাত্রবর্ণ গনগনে লাল। নুরুমিয়ার গোসলখানার পিছে, দেয়ালের চিপায়, ডাবগাছের সাথে বাঁধা থাকতো। নুরুমিয়া বলতো দিনের বেলা কুকুর বেঁধে রাখা নিয়ম। নাইলে ওদের গায়ে রাগ জমে না।

রাতে ছাড়া পেয়ে ও সমস্ত বাড়ি চরকির মতো ঘুরতো এবং কাঁঠালপাতা দেখলেও ঘেউ ঘেউ করতো। আমরা মেয়েটির গতরে যথেষ্ট রাগ ঢুকাতে পেরেছিলাম। তবে তারও অকালমৃত্যু ঘটে। একদিন ভোরবেলা দেখি সেন্ট্রাল রোডের মোড়ে কসাইয়ের দোকানের সামনে আমাদের তাগড়া লাল রাগী কুকুরটা মরে শক্ত হয়ে আছে। সবাই বলে গাড়ির ধাক্কা খেয়েছে। আমরা ভূতের গলি থেকে আবার একটা শিশুকুকুর ধরে আনি।

একদিন সূর্যগ্রহণ হয়। আমাদের হাতে মোটা কালো কাচ ধরিয়ে দেয়া হয়। আমরা কাচের আড়াল থেকে দেখি – পেয়ারাগাছের পাশে, আমগাছের মাথায় সূর্য কালো হচ্ছে। আমাদের তাজ্জব হতে বলা হয়। আমরা তেমন তাজ্জব হইনা। ঝুলন্ত গ্যাসপাইপে ভর দিয়ে দেয়ালে উঠি। দেয়াল টপকে পশ্চিমপাশে তরুনানার গলিতে যাই। ওই গলিতে কটকটিওয়ালা আসে। রতন গাঁজা খায়। রতন ঢাকা মেডিক্যালের ডোম। উনি অনেক লাশ কেটেছে। রতনডোম গাঁজা খেলে ধমক দিতো না। বলতো গাঁজা খাওয়া ভাল না।

‘সাহাবহ্যার’ গেটের দক্ষিণপাশে রঙ্গন গাছ। ফৃ স্কুল স্ট্রিট হতে ধূলা এসে রঙ্গনের লাল থোকা গেরুয়া করে ফেলতো।

দুপুরবেলা হাতিরপুল রঙ্গনের থোকার মতো নীরব হয়ে যেত। পাড়ার হোটেলে ‘বিজ্ঞাপন তরঙ্গ’ বাজতো – সাবিনা ও এন্ড্রু কিশোর। মাঝে মাঝে হিন্দি গান শোনা যেত। বাচুপান কে দিন ভুলা না দেনা, আওয়ারা হু, সাইয়া দিলমে আনা রে। দুপুর তিনটার দিকে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেলে এসব গানের কথা ও সুর ভাল মত শোনা যেত।

আমরা গোপন ল্যাবরেটরিতে ফিস ফাস করতাম। আমাদের বানানো ওষুধ সাবধানতার সাথে নাড়াচাড়া করতাম। ইহা বিষ। আমরা আমাদের উদ্ভাবিত বিষ তেলাপোকা টিকটিকি ইত্যাদির গায়ে ঢেলে পরীক্ষা করতাম। তেলাপোকা যমের অরুচি, ঝিম মেরে থাকতো। নুরুমিয়া আমাদের কাজকর্মে বিরক্ত হতো।

 

০২

এক ঈদের দিন সন্ধ্যাবেলা ১৪৬ এর সামনের ফুটপাথে শাড়ি চুড়ি ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছিল। ফিরোজা বেগমের নাতি দরদাম করে এবং তার নানির রায়ট থামানোর গল্প করে। তখন প্রায় রাত রাত। রহস্যময় একটা উজ্জ্বলতা বাজার থেকে সেন্ট্রাল রোডের মাথা পর্যন্ত বিরাজমান। ১৪৬ এর টাকমাথা সেজো জামাইয়ের বউ শাড়ি চুড়ি ইত্যাদি বিক্রি করে। আমি তাকে সাহায্য করি। হাফিজাবানুর বড় মেয়ে কেনে। হাফিজাবানুর ছোট ছেলেও ফুটপাথে বসে আমাদের ক্ষুদ্র ব্যাবসায় যোগ দেয়। ভাই-বোনের এই মিলন দৃশ্য খুব মনোরম। এর মধ্যে তরুনানার গলিতে একটা খুন হলো।

আমি বের হয়ে গলির মুখে চা খাই। একশ ছিচল্লিশের পূবপাশে ফৃ স্কুল স্ট্রিট, পশ্চিমপাশে তরুনানার গলি। গলির মুখে বিশ পঁচিশজন মানুষ জটলা করছে। চা খাচ্ছে। ওখানে একজন ম্যাজিশিয়ান ছিল। উনি ম্যাজিক দেখাতে চাচ্ছিল। উনি একটা চকির উপর উপবিষ্ট হয়। আমি সামনে দাঁড়ানো।

আমরা বুঝি ওখানে একটা খুন হয়েছে। কিন্তু কে আততায়ী, কে শিকার ইত্যাদি পরিষ্কার না। ডেডবডিও পরিষ্কার না। শুধু তরুনানার গলিতে রক্তজবা ফুলের মতো লাল একটা ছায়া দৃশ্যমান। ছায়াটা স্থির না। ধীরে ধীরে গলি ঢেকে ফেলছে। আমি দেখি আশপাশের দালান থেকে কাজের বুয়ারা মুখ বার করে আছে। কথা বলছে।

লাল ছায়াটা ধীরে ধীরে গলি ঢেকে ফ্যালে। আমি নিচ থেকে বুয়াদের বাক্যালাপ শুনতে পাই। ওনারা দোতলা তিনতলা চারতলার জানলা থেকে বলাবলি করে ছায়াটা ঠিক ঠাক তৈরি হলো কিনা। যেন এটা একটা নাটকের সেট এবং তাদের উপর লাইটিং ঠিক রাখার দায়িত্ব পড়েছে।

*

আমরা শুনেছি, ঊনিশশো একাত্তর সনে ঢাকা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল। ১৪৬ নং হাতিরপুলেও সেই পরিবর্তনের প্রভাব দেখা দেয়।

৭ই মার্চ নূর হোসেন, ওরফে নুরুমিয়া লাঠি হাতে রেসকোর্স যায় শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে দালানের ছাদে প্রতিবাদমূলক কালো পতাকা টাঙানো হয়। বাসার ভিতর রইছউদ্দীন সাহেবের সেজো মেয়ে রাত জেগে বাংলাদেশের পতাকা সেলাই করে। কিছুক্ষণ পর কালো পতাকার পাশাপাশি একটি আনকোরা লাল-সবুজ পতাকাও উড়তে দেখা যায় ছাদ থেকে।

আমরা শুনেছি, পচিশে মার্চের রাতে গোলাগুলি শুরু হলে জনাপঞ্চাশেক মানুষ একশ ছিচল্লিশের দালানের নিচতলার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। সবাই মেঝেতে, খাটের উপর, খাটের নিচে গাদাগাদি করে ঘাপটি মেরে ছিল। হাতিরপুল, পুকুরপাড় ফৃ স্কুলের লোকজন, ভাড়াটিয়া গায়ক বশির আহমেদ ও তার স্ত্রী মিনা বশির, দোকানদার, দরজি সবাই অন্ধকার বড় ঘরে একে অপরের সাথে সেঁটিয়ে ছিল। ওই রাত নাকি ছিল টিভিতে সাপ্তাহিক ছায়াছবির রাত। নুরুমিয়া সবাইকে বলে “ভয় পাও ক্যান? ভয় পাইও না”। উঠানে বৃষ্টির মতো গুলি এসে পড়তে থাকে। টিনের চালে ঝন ঝন শব্দ হতে থাকে।

পরদিন উঠানে অনেকগুলি বুলেট পাওয়া যায়। রইছউদ্দীনের সেজো মেয়ে বাথরুমে যাওয়ার সাহস পায় না। বড়ই গাছের গোড়া থেকে গুলি কুড়ায় এবং ভয় পায়। দালানের সামনে রাস্তায় একজন রিকশা চালকের রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

২৮শে মার্চ কারফিউ তোলা হলে ১৪৬ এর আতঙ্কিত বাসিন্দারা বিক্রমপুরের গ্রামের দিকে রওনা হয়।

নুরুমিয়া সবাইকে পথ দেখিয়ে সদরঘাট পর্যন্ত আনে এবং হঠাৎ আবিষ্কার করে যে দালানের ছাদে এখনো লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে। যেহেতু পাক আর্মির গাড়ি ওই দালানের সামনেও থামে এবং সেখান থেকেও অলিতে গলিতে ঢোকে, সবাই আশঙ্কা করে যে ওই পতাকা ওরা খেয়াল করবে এবং বোম মেরে ১৪৬ এর দালানটা উড়ায় দিবে। কাউকে না কাউকে পুনরায় হাতিরপুলে ফেরত যেতেই হবে। কিন্তু যাবেটা কে? নুরুমিয়া বলে “ভয় পাও ক্যান? ভয় পাইও না”। ওনার কথায় কারও ভয় কাটে না। তথাপি সবাইকে গ্রামের পথে রওনা করিয়ে দিয়ে, রইছউদ্দীন সাহেবের আজীবন অনুগত নূর হোসেন, ওরফে নুরুমিয়া, একা একা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবরুদ্ধ হাতিরপুলে ফেরত আসে। ১৪৬ এর ছাদ থেকে পতাকা নামায়।

১৪৬ নং হাতিরপুলের দালান, ২০১৫
১৪৬ নং হাতিরপুলের দালান, ২০১৫

রইছউদ্দীন ও হাফিজাবানুর আত্মীয়স্বজন মানিকগঞ্জের দিকে যুদ্ধ করেছে। পরে তারা কেউ আমাদের সম্মুখ যুদ্ধের গল্প করতে আগ্রহ দেখাতোনা। তাদের এই অনাগ্রহ দেখে আমাদের মনে হতো যুদ্ধের বীরত্বের কথা যুদ্ধফেরত মানুষ যেমন বলতে পছন্দ করে বলে আমরা নাটক সিনেমায় দেখি, বাস্তবে সব সময় ততটা রোমান্টিকটা কাজ করে না। বরং যুদ্ধের কঠিন স্মৃতি অনেকেই মনে করতে চায় না।

তবে একাত্তর সালের ১৪৬ নং হাতিরপুল নিয়ে কিছু কিছু বিছিন্ন ও সাদামাটা ঘটনা আমরা একাধিক সূত্র থেকে জেনেছি।

রইছউদ্দীন সাহেবের বড় মেয়ে পোয়াতি বিধায় ১৪৬ এর বাসিন্দারা অগাস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে বিক্রমপুর থেকে ঢাকা ফিরে আসে। ওই সময় একদিন একশ ছিচল্লিশের দালানের সামনে একটি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক এসে থামে এবং কামানের নল উপর দিকে তাক করে ফাঁকা ফায়ার করে। প্রতিটা ইট কেঁপে ওঠে। দালানের পেছনের আমগাছে কাকগুলি কা কা করে। বাড়ির ভিতর কেউ টু শব্দ করে না। আতঙ্কিত অবস্থায় চিন্তা করতে থাকে মাউরা আর্মির বক্তব্য কী?

তিনতলায় ভাড়াটিয়ার ছেলে সুস্থ ছিল না – অন্ধকার দেখলে ভয় পেতো। এক রাতে ব্ল্যাক-আউটের সময় পুত্রের বিকারে ধৈর্য হারিয়ে তিনতলার ভাড়াটিয়া কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘরের বাতি জ্বালিয়ে আবার অফ করে দেয়। পুলের উপর অবস্থান নেয়া পাক আর্মি ওই আলোর ঝলকানিকে মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য কোনো গোপন ইশারা ভেবে ১৪৬ বরাবর গুলি ছোঁড়ে। গুলিটা দরজা ভেদ করে ঘরের দেয়ালে বাড়ি খায় এবং ছিটকে ভাড়াটিয়া ভদ্রলোকের পায়ে আঘাত হানে।

ব্ল্যাক-আউট শেষে আহত ভদ্রলোককে হাসপাতালে নেয়ার জন্য বের করা হলে গেটের সামনে পাক আর্মি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিল- “মাফ কি জিয়ে জানাব, গালদি হো গেয়া”। তিনতলার উত্তরের ঘরে সেই গুলির দাগ আমরা দেখেছি।

*

হাফিজাবানুর বোনের বাসা ১৪৬ এর ঠিক পিছে, ফৃ স্কুল স্ট্রিটের উপর। ওনার ছোট ছেলের বিয়ে হয় যুদ্ধের বছর অক্টোবর মাসে। বিয়ের দিন দুপুরবেলা আত্মীয়স্বজন জমায়েত হয়েছিল। যেইটুকু অনুষ্ঠান হবার ঠিক ঠাক মতো হলেও সন্ধ্যায় একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে।

যুদ্ধের সময় হাতিরপুলের মানুষ দিনের বেলা বের হতো নিতান্ত প্রয়োজনে। যারা অফিস করার করতো। অফিস টাইম আটটা থেকে দুইটা। বিকাল হতে হতে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। মানুষ দরজা জানলা আটকায় ঘরে বসে নিচু আওয়াজে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতো, এখানে সেখানে বোম ফোটার আওয়াজ শুনতো। খদ্দের না থাকায় দোকানপাটও সন্ধ্যার আগে আগে বন্ধ হয়ে যেত।

একশ ছিচল্লিশের ঠিক উল্টাপাশে, রাস্তার উপর ‘আলি ফার্মেসি’। ফার্মেসির মালিক জনাব আলি একজন বিহারী। ইতিমধ্যে হাতিরপুলের মানুষ ওনাকে ভয় পেতে শুরু করেছে। তারা দেখতো আলির রকম সকম সুবিধার না। আগে যেমন স্বাভাবিক লাগতো, যুদ্ধ শুরুর পর আর তেমন মনে হচ্ছে না।

বিয়ের দিন সন্ধ্যায়, তখনো সব মানুষ চলে যায় নাই, হঠাৎ এক ঝলক গুলির শব্দ ভেসে আসে। পরক্ষণেই সবকিছু ঠান্ডা।

বিয়েবাড়ির গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ কথা বলে না। গুলির শব্দ আসলো কোন দিক থেকে? কেউ ভাবে পশ্চিম, কেউ ভাবে দক্ষিণ। অসহ্য নীরবতায় উপস্থিত সকলের কৌতুহল চরমে পৌছায়। তারা আর থাকতে পারে না। আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এবং একশ ছিচল্লিশের দালানের সামনে, রাস্তার উপর জনাব আলি এবং ওনার দুই আত্মীয়ের ছিন্নভিন্ন লাশ আবিষ্কার করে।

জনশ্রুতি যে, আলিকে মেরেছিল নায়ক খসরু, মুরগি মিলন, মোস্তফা মহসীন মন্টু প্রমুখের গেরিলা ইউনিট। এই ঘটনা হাতিরপুলবাসীদের মনে ত্রাস সঞ্চার করে। সবাই ভাবে মাউরা আর্মি এবার এলাকায় নতুন করে ধড়পাকড় শুরু করবে।

তাদের আশঙ্কা যে পুরাপুরি ভুল ছিল তাও না। ঘটনার পরপরই এলাকা পাক আর্মি দিয়ে ভরে যায়। কয়েকজন ১৪৬ এর দরজা ধাক্কাধাক্কি করে। তারা বলে “দরওয়াজা খোলিয়ে সাহাব কুছ নেহি কারেঙ্গে”। কেউ সাড়া দেয় না।

তবে জনাব আলির হত্যা নিয়ে পাক আর্মি বিশেষ কোনো জিঘাংসা অনুভব করে নাই শেষ পর্যন্ত। কিছুক্ষণ গুতাগুতি করে চলে গিয়েছিল। নতুন দম্পতির বাসর রাত কেটেছিল অন্যরকম এক উত্তেজনায়।

যুদ্ধের নয় মাস রইছউদ্দীন সাহেব ঢাকা থেকে অফিস করেছে। ওনার সাথে ১৪৬ এ থাকতো নুরুমিয়া। সপ্তাহের শেষে দুইজন হাঁটাপথে বিক্রমপুর চলে যেত। রইছউদ্দীন খান ও নুরুমিয়া বাদে ১৪৬ এর বাসিন্দারা এই নয় মাস কখনোই একটানা ঢাকায় থাকে নাই। বিক্রমপুর থেকে যাওয়া আসা করেছে। ডিসেম্বরে ভারতীয় গোলাবর্ষণ শুরু হলে সবাই আবার বিক্রমপুর চলে যায়।

 

০৩

১৪৬ নং হাতিরপুলে নানা ধরণের মানুষের আনাগোনা ছিল। ভাড়াটিয়া, আত্মীয়, দোকানদার, মিসকিন, নাপিত, ম্যাথর, ফেরিওয়ালা, অভিনেতা, গায়ক, চিত্রকর চেনা অচেনা অনেক মানুষ।

আশির দশকের এক দুপুরবেলা এক অপরিচিত ভদ্রলোক একশ ছিচল্লিশে উদয় হয়। উনি নাকি ৩৬ বছর পর আমেরিকা থেকে এসেছে এবং খোঁজ করে ১৪৬ এর বাড়িটা বের করেছে। উনি নিজেকে একশ ছিচল্লিশের প্রাক্তন মালিকের পুত্র বলে পরিচয় দেয়। এই বাড়িতে ওনার জন্ম।

আগন্তুকের সাহেবি চাল চলন দেখে, এবং এই বাড়ির সাথে ওনার ঐতিহাসিক যোগসূত্রের কথা জানতে পেরে ১৪৬ এর বাসিন্দারা আমোদলাভ করে। আমেরিকা প্রবাসী ভদ্রলোক বলে বাড়িটা এত বছর পরেও খুব একটা বদলায় নাই।

ভদ্রলোক সারা বাড়ি ঘুরতে থাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। এখানে এই ছিল, ওখানে ওই ছিল ইত্যাদি অনেক কথা বলে আবেগতাড়িত ভঙ্গিতে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর হারিয়ে ফিরে পাওয়া বাল্যস্মৃতির ১৪৬ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত আচরণ করে। তার আচরণ ১৪৬ এর বর্তমান বাসিন্দাদের মনে দাগ কাটে। তারা মনে মনে কিছুক্ষণের জন্য দার্শনিকে পরিণত হয়। ১৪৬ কে মহাকালের শাদা কাগজে স্থাপন করে বাকরুদ্ধ হয়। এই ভদ্রলোকটির মতো কি তারাও একদিন চলে যাবে অন্য জায়গায়? তারাও কি বহু বছর পর এমন ভাবে ফেরত আসবে? বা আসবে না? বা আসতে চাইলেও আসতে পারবে না? মনের ভিতর আবছা ভাবে কিছু একটা টান মারতে থাকে।  কিন্তু এসব চিন্তায় তারা বেশিক্ষণ বিভোর থাকতে পারে না।

আমেরিকা প্রবাসী ভদ্রলোক একই কথা বার বার বলতে থাকে- “বাড়িটা এত বছর পরেও তেমন বদলায় নাই”। একশ ছিচল্লিশের বর্তমান বাসিন্দারা হাসি হাসি মুখ করে বলে “চিন্তা কইরেন না, আপনে আরো তিরিশ বছর পর আসলেও এই বাড়ি একই রকম দেখবেন”।

 

০৪

আশির দশকে হাতিরপুল অন্যরকম ছিল। হাফিজাবানুর ছেলেরা বলতো, ৫০-৬০ দশকে হাতিরপুল অন্যরকম ছিল। বলতো- “তোমরা ত হাতিরপুলের হাতিও দেখো নাই, পুলও দেখো নাই, পুলের নিচে রেললাইনও দেখো নাই”।

“এখন যেইখানে ফৃ স্কুল স্ট্রিটের মাথা, পুলটা সেইখান থিকা শুরু হইতো। শেষ হইতো পরীবাগ মসজিদের ধারে। পঞ্চাশ-ষাইটের দিকে আমরা পুলের উপর আড্ডা দিতাম বাদাম খাইতাম বিকালে”।

“আমরা পুলের উপর দাঁড়ায় দেখতাম দূরে, তেজগাঁ থিকা রেলগাড়ি ছাড়তেছে ফুলবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে। একটু পর কাওরানবাজার ঘুইরা হাতিরপুল আসবে। আমরা গল্প করতে করতে রেলগাড়ির জন্য অপেক্ষা করতাম। পুলের উপর হাতি উঠতো না তেমন, নিচ দিয়া যাইতো। নবাবের হাতিগুলি পিলখানা থিকা হাতিরপুল দিয়াই মগবাজারের ঝিলে নেয়া হইতো।”

ওনাদের কথায় আমরা অল্প অল্প অবাক হই। বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পুল এবং ইতিহাসের হাতির উচ্চতা কত হতে পারে চিন্তা করি।

পুল ভাঙা হয় যুদ্ধের পর তিয়াত্তর সালে। হাফিজাবানুর ছেলেরা বলে- “হাতিরপুল বাজার ত সেদিন বানাইলো এরশাদ! ষাইটের দশকে এলাকায় বাজার আছিলো কাওরানবাজার। সবাই রেললাইন ধইরা বাজারে যাইতো। আমরা পোলাপানরা বল খেলতাম শাহবাগের আনসার গ্রাউন্ডে, এখন যেখানে যাদুঘরের দালান। খেলা শেষে মাঠের পাশে পুকুরে নামতাম। সেই পুকুরের অংশবিশেষ ত এখনো আছে। যাদুঘরের পিছন দিকে আছে।”

“তোমরা যেই জায়গাটারে কাঁটাবন ডাকো, সেইটা কিন্তু আসলেও কাঁটার বন আছিলো! আমরা আনসারগ্রাউন্ড থিকা সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরার সময় কাঁটাবনের দিকে যাইতাম না। ভূতের ভয় পাইতাম। কাঁটাবনে একটা শ্মশান আছিলো”।

...

মেসবা আলম অর্ঘ্য। মেসবা আলম অর্ঘ্য ।

কবি ও গদ্যকার

2 Comments

Filed under সারথি

2 responses to “একশ ছিচল্লিশ নং হাতিরপুলের গাছপালা (দ্বিতীয় পর্ব) / মেসবা আলম অর্ঘ্য

  1. Max Tanim আছে।”
    “তোমরা যেই জায়গাটারে কাঁটাবন
    ডাকো, সেইটা কিন্তু আসলেও
    কাঁটার বন আছিলো! আমরা
    আনসারগ্রাউন্ড থিকা ভালো হয়ে ছে

    Like

  2. Darshan

    Well written ) but some times you may English words, if you need any type of information you are always welcome to ask !

    Like

Leave a reply to Darshan Cancel reply