একশ ছিচল্লিশ নং হাতিরপুলের গাছপালা / মেসবা আলম অর্ঘ্য

প্রথম পর্ব

 

১৪৬ নং হাতিরপুলে আশির দশকে দুইটা আমগাছ ছিল। আমগাছ মুকুল দিতো। লিচুগাছ ছিল। লিচুগাছ মুকুল দিতো। আমরা লিচুগাছ বেয়ে পানির ট্যাঙ্কে উঠতাম। কাক ডিম দিতো, শিশু দিতো। কাঁঠালগাছে বিড়াল উঠতো। উঠানে শিউলি ফুটতো। ভূতের মতো লম্বা লম্বা ডাবগাছ। মধ্যেখানে হাফবিল্ডিং।

আশির দশকে হাতিরপুল অন্যরকম ছিল। আমরা পেয়ারার ডাল বেয়ে টিনের চালে যেতাম। কষ্টা পেয়ারা পাকার সময় দিতাম না। একপাশে গন্ধরাজ ও লতানোজবার ঝাড়। গন্ধরাজ কালেভদ্রে হতো, পাপড়ি মেলতো সুরভি ছড়াতো। লতানোজবা হতো প্রতিদিন। কিন্তু কখনো পাপড়ি মেলতোনা। তার সুরভি ছিলনা। মরিচের মতো লাল হয়ে বুজে থাকতো কেবল। লতানোজবার গোড়ায় মধু ছিল। খেতে মিষ্টি।

কলপাড়ের একপাশে কবুতরের খোয়াড়। অকেজো তক্তার স্তুপের উপর কবুতর বসে থাকতো। নুরুমিয়ার গোসলখানায় চৌবাচ্চা ছিল। খুব অন্ধকার। চৌবাচ্চায় পানি আছে কি নাই হাত না ঢুকালে বোঝা যেত না। কলপাড় শ্যাওলায় পিছল। আমরা পা টিপে টিপে যেতাম। ১৪৬ নং হাতিরপুলে দুইটা উঠান ছিল আশির দশকে। নুরুমিয়ার পাকঘরে বেজি আসতো। নুরুমিয়া একদিন বেজি ধরেছিল।

আমাদের গোপন ল্যাবরেটরি ছিল। ট্যাবলেট থেৎলে মিকচার বানাতাম। ফেনারগানের শিশি, হোমিওপ্যাথের বাক্স। কার্তুজ বানানোর যন্ত্র ছিল চাবিওয়ালা। আমরা উঠানে টোপ ফেলে চড়ুই ধরতাম। চড়ুইপাখি জবেহ করে রান্না বসাতাম শিউলিগাছের নিচে। মাঝে মাঝে ইঁদুর ধরতাম। একবার এক বাইত্তা ইঁদুরের লেজে রশি বেঁধে টান মারতে লেজের চামড়া খুলে আসে। ইঁদুরের চামড়াহীন লেজ দেখতে লিলিফুলের কেশরের মতো।

টিনের চালে বৃষ্টি হতো। খইয়ের মালার মতো বৃষ্টির পানি নেমে আসতো চালের কোণা থেকে। মটরঘরে কোলাব্যাং ছিল। প্রায় প্রায় ডাকতো। বৃষ্টি হলে উঠানে পানি জমতো। আমরা কাগজ দিয়ে নৌকা বানাতাম। বর্ষাকালে উঠানের দুইধারে লিলি ফুটতো। নুরুমিয়া দোকানের জন্য ডালপুরির মশলা বানাতো দুপুরবেলা। একদিন নুরুমিয়ার পাকঘরে আমি মিষ্টিআলু ভেবে চামড়া ছেলা মানকচুতে কামড় বসিয়ে ফেলি। মনে হয় যেন বিষ খেয়েছি। জবাইয়ের মাঝপথে ফসকে যাওয়া গরুর মত কাৎরাতে কাৎরাতে সারা উঠান দৌড়াই।

*

পূবপাশে ফৃ স্কুল স্ট্রিট। ওদিকের গেট কখনো খোলা হতোনা। ওই গেটে নাকি পাক আর্মি ধাক্কাধাক্কি করেছিল পঁচিশে মার্চের পর। চিৎকার করে জানতে চেয়েছিল সাহাব হ্যায়? সাহাব হ্যায়? ওই গেটটা আমাদের কাছে ‘সাহাবহ্যার’ গেট। কখনো খোলা হতোনা। যদিও শুনেছি একসময় ওইটাই মেইনগেট ছিল। ১৪৬ হাতিরপুল তখন ছিল ১০ ফৃ স্কুল স্ট্রিট। গেটের উপর ঝাপড়া মাধবীলতা ছিল। বামপাশে তেঁতুল গাছ।

ফৃ স্কুল স্ট্রীটের গলি দিয়ে মাগরিবের পর একজন মানুষ বের হতো। শিকের মতো চিকন হাত-পা, লম্বা তৈলাক্ত চুল। শাদা লুংগি ঘাড়ের উপর টেনে বুকের কাছে গুটিয়ে ধরতো। হাতে লাঠি থাকতো। লাঠির একমাথা রূপালি। উনি প্রতিদিন উঁচু গলায় কিছু একটা ডাকতে ডাকতে যেত। ডাক শুনে পরিষ্কার বোঝা যেত না আসলে কী বলছে। কেউ ভাবতো ‘দে’, কেউ ভাবতো ‘কে’। ওনার স্থা্নীয় নাম ‘কে-বাবা’।

কে কে কে, কিংবা দে দে দে বলে পাড়া কাঁপায় ডাকতে ডাকতে প্রতিদিন মাগরিবের পর কেবাবা আমাদের তেঁতুল গাছের পাশ ঘেষে ফৃ স্কুল স্ট্রীটের গলি দিয়ে হাতিরপুলে উদয় হত, এবং হন হন করে কই যেন চলে যেত। অনেকে বলতো উনি পুরা ঢাকা শহর চক্কর দেয়। আমরা মনে মনে চিন্তা করতাম লুঙ্গির নিচে ওনার কোনো হাফপ্যান্ট আছে কিনা।

হাতিরপুলের অনেক বৃদ্ধার মতোন হাফিজাবানু, মানে ‘সাহাবহ্যার’ বিবিসাহেব কেবাবার প্রতি উৎসাহী ছিল। প্রায় প্রায় রাস্তার মোড়ে মানুষ দাঁড় করায় রাখতো মাগরিবের সময়; কেবাবা আসলে যেন ধরে। বিবিসাহেব কেবাবার সাথে গল্প করতো। আদর করে খাওয়াতো। কেবাবা নাকি সাধারণ লোক ছিল। একদিন তার মা মারা যায়। উনি চিন্তায় পড়ে যায় এই ভেবে যে মা গেল কই। ওনার সেই চিন্তা আর দূর হয় নাই। তারপর থেকে কেউ আর ওনাকে সাধারণ ভাবে নাই।

মাথাব্যাথার দোষে আমাকে একবার কেবাবার হস্তগত করা হয়। উনি চেয়ারে উপবিষ্ট, আমি সামনে মেঝেতে জোড়াসীন। কেবাবা বলে তাকাওতো আমার দিকে! আমি লতানোজবার মতো তাকাই। কেবাবা বলে ভয় নাই ভাল মত তাকাও। আমি চোখ খুলি। কেবাবা আমার থুতনি ধরে হাসে। এবং হাসতে হাসতে চোখের ভিতর গোলাপজল ছিটাতে শুরু করে বিকট ভঙ্গিতে। যন্ত্রণায় আমার চোখ বন্ধ হয়। কেবাবা চিৎকার করে বলে চোখ বন্ধ করবা না! চোখ বন্ধ করবা না!

*

প্রৌড় হাফিজাবানু আমাকে অনেক গল্প শুনিয়েছে। বেশিরভাগই হিন্দু পুরাণের গল্প। রাতেরবেলা কারেন্ট চলে যাওয়ার পর উঠানে খাটিয়া পেতে হাবিজাবি নানান কিচ্ছা শোনাতো আর বলতো- ‘আরামপ্রিয় হয়োনা’।

ততদিনে আমি পাড়ার মাদ্রাসায় সিপারা শুরু করেছি। সুর করে আরবি পড়ি। মাঝে মাঝে কাগজের চোং বানিয়ে পাড়ার মুয়াজ্জিনের সাথে গলা মিলায় আজান দেই। হাফিজাবানু আমোদলাভ করে। চোখের তারা ঝিকমিকিয়ে পিতামাতার গল্প করে। ওনার একটা ফাঁপা পালং ছিল। জাজিম তুললে ঢাকনাওয়ালা গর্ত দেখা যেত। সেই গর্ত আমাদের টানতো চুম্বকের মতো। আমরা প্রায় প্রায় হাত ঢুকাতাম, তবে তেমন কিছু হাতে ঠেকতোনা।

১৪৬ নং হাতিরপুলের সামনে ফুটপাথে রোজার ঈদে মেলা বসতো। কাচের চুড়ি তারাবাতি আলতা চটপটি। আমরা নামাজের পর এইবাসা ওইবাসা ঘুরতাম সালামি টোকাতাম। যথেষ্ট বড়লোক হবার পর মেলায় যেতাম। নতুন নতুন খুচরা নোটের চাপা উত্তেজনা চটপটি গাড়ির ধোঁয়াওঠা আলুসিদ্ধ আর সস্তা নেলপালিশের গন্ধের সাথে মিশে মিশে এক আজব পরিস্থিতি তৈরি হতো।

কোরবানির ঈদে মেলা হতো না। গরুজবাই হতো। সদ্য জবেহকৃত গরুর রক্ত কলপাড়ে শ্যাওলার উপর ড্রেনের দিকে সরতে সরতে জমাট বেঁধে যেত। আমরা উঠানে মাদুর পেতে মাংস কাটতাম। চাপাটির কোপ বসাতাম আর ছোট ছোট হাড়ের টুকরা, চর্বির টুকরা পাশের গন্ধরাজ গাছে লেপ্টে যেত। উৎসর্গকৃত গরুর খুলি অনেকক্ষণ পড়ে থাকতো কলপাড়ের কোণায়। যেন সেটা সরানোর কথা কারো মনে নাই। কিংবা সবাই উৎসর্গকৃত গরুটির দন্তবিকশিত চোয়াল দেখে আমাদের মতই ভয় পাচ্ছে।

প্রত্যেক কোরবানির ঈদে দুপুরের পর, যখন কাটাকাটি শেষ, তখন বৃষ্টি নামতো। প্রত্যেক কোরবানির ঈদে দুপুরের পর অবধারিতভাবে বৃষ্টি নামতোই। গোবর আর রক্তের গন্ধের সাথে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ মিলেমিশে যেত।

আমরা ততক্ষণে ক্ষুধার্ত হয়েছি, সাবান ডলে গোসল করেছি। ওয়াজুদ্দিমিয়ার ছেলেরা রাস্তার ওইপাড়ে সেলুনের পাশে স্পিকার লাগিয়ে গান ছাড়তো। পাড়া জুড়ে ওয়াজুদ্দিমিয়ার ছেলেদের প্রিয় প্রিয় গানের উপর, গোবর ও রক্তের পুডিঙের উপর বৃষ্টি নামতো। আমরা মাংস খেতাম।

 

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর গ্রাম রাড়িখাল। রাড়িখালের অদূরে আরেকটা গ্রাম আছে বিক্রমপুরে – ষোলঘর নাম। একশ ছিচল্লিশের হাফিজাবানু সেই ষোলঘর গ্রামের মেয়ে। ষোলঘরে আগে বহু হিন্দু পরিবার ছিল। এখন অত না থাকলেও অনেক আছে। কুমারপাড়ার দিকে আছে। ষোলঘরে দুর্গাপুজা হয়।

হাফিজাবানুর পিতা ছমিরুদ্দীন খান কঠিন পরহেজগার ব্যক্তি এবং সুফি পীর হিসাবে এলাকায় পরিচিত ছিল। যদিও আমরা শুনেছি উনি ধুতি পরতো এবং ওনার বন্ধুবান্ধব অনেকেই ছিল হিন্দু।

আমরা শুনেছি, হাফিজাবানুর মা ফিরোজা বেগমকে ‘দিদি’ ডাকে এবং যারপরনাই ইজ্জত করে এমন এক হিন্দু ভদ্রলোক ১৯৪৭ এর ঠিক আগে আগে, যখন দেশ ভাগ হয় হয়, এমন এক সময়খন্ডে ফিরোজা বেগমের মেজো ছেলে ওয়াছেলউদ্দীন আহমেদের সাথে কোনো এক বিবাদে জড়িয়ে পড়ে এবং ওনার গালে থাপ্পড় দেয়। হিন্দু হাত তুলেছে মুসলমানের গায়ে – এই আবেগকে কেন্দ্র করে, এবং দেশভাগের বাতাস ষোলঘরেও বিদ্যমান আছে বিধায় এলাকায় দাঙ্গা বাধার উপক্রম হয়। হিন্দুদের পিটাতে কতিপয় মুসলমান একত্রিত হয় এবং স্থানীয় মাতবরদের সাথে পরামর্শ শুরু করে। পরিস্থিতি চরমে পৌছায়।

এক পর্যায়ে ফিরোজা বেগম সব জানতে পারে। উনি মাতবরদের ডেকে পাঠায় এবং বলে – ‘তোমরা আসছো আমি খুশি হইলাম। আমার ছেলেরে মারছে আমার ভাই। এর বিচার আমি নিজে করুম। তোমরা এইবার যাও’।

চল্লিশ বছর যাবৎ চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধ ফিরোজা বেগমের এক কথায়, ১৯৪৭ এর আগে আগে, যখন দেশ ভাগ হয় হয়, এমন সময়খন্ডে ষোলঘর গ্রামের অবধারিত রায়ট থেমে যাওয়ার এই গল্প একশ ছিচল্লিশের নানান সাদামাটা কিংবদন্তীর মতো ফিরোজা বেগমের নাতিনাতকুর, অর্থাৎ হাফিজাবানুর ছেলেমেয়ে, তাদের ছেলেমেয়ে, এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের ভিতরেও চলমান থাকে। তারা প্রায় প্রায় ষোলঘর প্রসঙ্গে, ধর্ম প্রসঙ্গে, এমনকি কবি নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গেও এইসব কাহিনী বলাবলি করে।

 

১৪৬ নং হাতিরপুলের আমগাছ ও হাফবিল্ডিং

১৪৬ নং হাতিরপুলের আমগাছ ও হাফবিল্ডিং

১৪৬ নং হাতিরপুল বিংশ শতাব্দীর শুরুতে হিন্দুবাড়ি ছিল। আরও বেশি গাছপালা ছিল। মধ্যেখানে মাটির বসতবাড়ি। উঠানে একটা কুয়া। চল্লিশের দশকে হাফিজাবানুর স্বামী রইছউদ্দীন খান ১৪৬ ক্রয় করে।

রইছউদ্দীনের মুসলমান আমলে মাটির দেয়ালে প্লাস্টার লাগে, মেঝে পাকা হয়। কুয়া ভরাট করে পামগাছ লাগানো হয়। পামগাছে লাল বড়ইয়ের মতো ফল ধরে। কষ্টা ফল খাওয়া যায় না, চড়ুইপাখি খায়। ১৯৬২ সালে রাস্তার দিকে একটি ছোট তিনতলা দালান ওঠে। পুরানো কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়। নতুন কিছু গাছ লাগানো হয়। অনেক নতুন মানুষের আনাগোনা শুরু হয়।

হাফিজাবানুর চিরকুমার ভ্রাতা, অভিনেতা মেসবাউদ্দীন আহমেদ ১৪৬ এ ভাড়া থাকতো। ওনার একটা মোটরবাইক ছিল। উনি নাটক সিনেমা করে বেশি সঞ্চয় করতে পারতো না বিধায় মোটরবাইক কিনে অর্থকষ্টে পড়ে।

বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি, অর্থাৎ অভিনেতা আনোয়ার হোসেন মেসবাউদ্দীন আহমেদের প্রিয়পাত্র ছিল। উনি ওইসময় স্বল্পখ্যাত ও অবিবাহিত হওয়ায় প্রায় প্রায় একশ ছিচল্লিশ নং হাতিরপুলে থাকতো।

হাফিজাবানু একদিন নবাবকে মেসবাউদ্দীনের বিষয়ে অভিযোগ করে বলে- ‘ওতো মোটরবাইক কেনার পর থেইক্কা ভাড়া দেয় না’! মেসবাউদ্দীন জানায়- ‘সারাজীবনে শখ আছিলো কেবল একটা বাইক, আমার ত বউয়েরও শখ নাই’! ভাইয়ের এই কথায় হাফিজাবানুর মন দ্রবীভূত হয়। আমরা শুনেছি জনাব আনোয়ার হোসেন বাস্তবিক ট্র্যাজিক নায়কের মত আবেগপ্রবণ ছিল। চোখ দিয়ে কথায় কথায় পানি ঝরতো।

চিরকুমার মেসবাউদ্দীন ওনার বড় বোনের পুত্রকন্যাদের দিয়ে আপন পুত্রকন্যার অভাব পূরণ করেছে। প্রায় প্রায় দেখা যেত উনি মোটরবাইকে ভ্রাম্যমান, পেছনের সিটে হাফিজাবানুর পুত্রকন্যারা। তারা এই ভদ্রলোককে বিক্রমপুরের ভাষায় ডাকতো সাইজ্জামামা। সাইজ্জামামার স্নেহ তারা কখনো ভুলতে পারে না। মৃত্যুর বহু বছর পরেও হাফিজাবানুর পুত্রকন্যাদের স্বপ্নে সাইজ্জামামা দেখা দিতে থাকে। তারা গভীর নস্টালজিয়ায় মোহগ্রস্থের মতো তাদের নিজেদের পুত্রকন্যাদের ভিতর, একশ ছিচল্লিশের অন্যান্য সাদামাটা কিংবদন্তীর মতো সাইজ্জামামার কিংবদন্তীও ছড়িয়ে দিতে থাকে।

…চলবে

...

মেসবা আলম অর্ঘ্যমেসবা আলম অর্ঘ্য

কবি ও গদ্যকার

1 Comment

Filed under সারথি

One response to “একশ ছিচল্লিশ নং হাতিরপুলের গাছপালা / মেসবা আলম অর্ঘ্য

  1. Beautifully written. Captured a piece of real history.

    Like

Leave a comment